সহিংসতা থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ফেরার স্বপ্ন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
২০২৪ সালের আদমশুমারির প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে মিয়ানমারের জনসংখ্যা ৫ কোটি ১৩ লাখ।
নতুন আদমশুমারি অনুযায়ী, এক দশক আগের তুলনায় দেশটিতে জনসংখ্যা কিছুটা কমেছে।
যদিও জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় ৫৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী গণনার আওতায় আসেনি বলে মিয়ানমার নাউয়ের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আদমশুমারিতে এবারো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে।
চলমান সংঘাত ও অস্থিরতার মধ্যেও মিয়ানমারে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। গত অক্টোবরে করা আদমশুমারি চলতি বছরের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা তৈরিতে ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে জান্তা সরকার।
বিরোধী দলগুলো অবশ্য এ নির্বাচনকে ‘সাজানো নাটক’ আখ্যা দিয়ে ব্যাপক সমালোচনায় নেমেছে।
যদিও দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং নববর্ষের ভাষণে বলেছেন, ‘আমি সফলভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছি, যা স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’
গত মঙ্গলবার প্রকাশ করা আদমশুমারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৪৪ শতাংশের তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন দায়িত্বে থাকা কর্মীরা।
কারণ গণনার এ কার্যক্রম কেবল জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। আদমশুমারির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ৫৮টি টাউনশিপে তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পরিচালনা করতে পারেননি।
ওইসব এলাকা জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সংঘাতপূর্ণ রাখাইন, কাচিন রাজ্য, সাগাইং অঞ্চল, শান রাজ্য, মান্দালয় অঞ্চল, চিন রাজ্য, কারেন্নি (কায়াহ) রাজ্য, মাগওয়ে অঞ্চলসহ দেশটির অনেক জনপদে আদমশুমারির তথ্য সংগ্রহ একেবারেই সম্ভব হয়নি।
মিয়ানমার নাউ এক প্রতিবেদনে জানায়, চলমান জাতিগত সংঘাতের কারণে অক্টোবরে পরিচালিত আদমশুমারির মাধ্যমে দেশজুড়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
মূলত জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রিত সীমিত অঞ্চল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এমনকি সরকারের আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের কার্যালয় থাকা মান্দালয় অঞ্চলের নাতোগি, সিঙ্গু ও থাবেইকিন শহরেও আদমশুমারির তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
আদমশুমারির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জান্তা সরকার সারা দেশের ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে কেবল ১৪৫টিতে জনসংখ্যা গণনা করতে পেরেছে, যা মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ। গণনায় দেখা গেছে, জান্তা অঞ্চলের ১৪৫টি টাউনশিপের মধ্যেও ১২৭টি তাদের আংশিক নিয়ন্ত্রিত।
এর আগে ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সরকারের অধীনে পরিচালিত এক আদমশুমারিতে নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে কাচিন, কারেন ও রাখাইন রাজ্যে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এতে আদমশুমারির আওতার বাইরে থেকে যায় অনেক জনগোষ্ঠী।
আসন্ন নির্বাচনের ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও জান্তা সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা ২০২৫ সালে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করবে। সেই সঙ্গে ভোটার তালিকা তৈরিতে ব্যবহার করা হবে আদমশুমারির তথ্য।
মিয়ানমারে ২০২১ সালের শুরু থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনী এবং গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ে কঠোর অবস্থান নেয়। এতে দেশব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। সামরিক বাহিনী এখন বেশ কয়েকটি এলাকায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
এরই মধ্যে অনেকগুলো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা সরকার দেশ শাসন করতে হিমশিম খাচ্ছে। পাশাপাশি দুর্বল অর্থনীতির সঙ্গেও লড়াই করতে হচ্ছে। অথচ সামরিক শাসন শুরুর আগে দেশটির অর্থনীতিকে একটি প্রতিশ্রুতিশীল আন্তর্জাতিক বাজার হিসেবে দেখা হতো।
আদমশুমারির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালে মিয়ানমারের জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি ১৩ লাখ। এক দশক আগে ২০১৪ সালের শুমারিতে এ সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ১৫ লাখ। দেশটির রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের কোনো আদমশুমারিতেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মিয়ানমারের ৫ কোটি ১৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে আদমশুমারিতে সরাসরি তথ্য নেয়া হয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ জনের এবং বাকি ১ কোটি ৯১ লাখের কাছে পৌঁছা সম্ভব না হওয়ায় তাদের সংখ্যাটি ‘আনুমানিক’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জরিপে তথ্য নেয়া হয়েছে উচ্চ রেজ্যুলেশনের স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে। রাশিয়া, চীন, ভারত ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া হয় এ প্রযুক্তিগত সহায়তা। নিরাপত্তাজনিত কারণে অবশ্য অনেক অঞ্চলেই আদমশুমারি পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
মিয়ানমারের জনসংখ্যা ৫ কোটি ১৩ লাখ হলেও বিশ্বব্যাংক বলেছিল ৫ কোটি ১৩ লাখ হতে পারে। জনসংখ্যা তাদের প্রক্ষেপণের চেয়ে কিছুটা কম। ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ ছিল ৫ কোটি ৭ লাখ।
উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালে দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ-মায়ানমারের সীমান্ত জেলা কক্সবাজারে আসে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের শিকার হয়ে কক্সবাজারে আসে আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত হামলা গণহত্যা চালানোর পর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আসে আরো সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদের সাথে আগে থাকা উল্লিখিতরা মিলে কক্সবাজার জেলা এখন ১৫ লাখ রেহিঙ্গা শরণার্থীর আবাসভূমি। এদের ছয় লাখ এখন আছে শরণার্থীদের জন্য নির্মিত কুতুপালং মেগা শিবিরে। আর এটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।
পাঠকের মতামত